Feb 15, 2008

অবিশ্রান্ত স্মৃতির মিছিল

[ঈষৎ পরিবর্তিত]

পূর্বে প্রজন্ম ফোরামে প্রকাশিত

শাবিপ্রবি সমাবর্তন [৬ ডিসেম্বর, ০৭]



[১]
আবার পুরোনো শহরে সবাই একসাথে হলাম। পাস করবার পরে ২-৩ বার সিলেট গিয়েছি। কিন্তু, এইবারের মত এত নস্টালজিয়া কখনো চেপে ধরে নাই। নস্টালজিয়ার ধাক্কায় ভার্সিটির আনাচে-কানাচের ছবি পর্যন্ত তুলে ফেলি। “চায়ের টং”, “এখানে ময়লা ফেলুন”, “রোড টু ইনফিনিটি”, “ক্লাস-রুম”, “নোটিস বোর্ড”।

অবশ্য, অনেকেরই অবস্থা আমার মত। একসাথে জড়ো হওয়াতে মনে হচ্ছিল সবাই এখনো আগের মতই ছাত্র। অডিটোরিয়ামের দরজা খুললেই পরীক্ষা দিতে ঢুকবো।

শুধু মাঝখান থেকে কেটে গেছে দেড়টা বছর!




[২]
এইবার সিলেটে যাবার জন্যে ৩৪ জনের একটা ‘চিল্লা-চিল্লি’ গ্যাং গঠন করা গেলো। ট্রেনের বগিতে উচ্চ-কন্ঠ তানিম থাকাতে শুরু থেকেই সবাই মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম বেশ রাত পর্যন্ত দন্ত প্রদর্শন করা যাবে। যথারীতি, ঘন্টা-খানিকের মধ্যেই আমাদের বগি অন্য বগির যাত্রীদের মনোঃ-কষ্ট এবং ঘুম-কষ্টের কারণ হয়ে দাড়ালো। টিকেট-চেকারের মাধ্যমে তারা হুমকি দিলো, চিল্লা-মিল্লি না থামাইলে ট্রেন অবরোধ করা হবে। শোনার পরে ৩০ সেকেন্ডের মত বগি অবশ্যি শান্ত ছিল।

প্রথম দিন পোস্টালের রেস্ট হাউসে উঠলাম। পরদিন সিলেটের মদিনা মার্কেট। সিলেটে আমরা যারা ৯/বি, পাঠানটুলায় থাকতাম, তাদের জন্যে চাচার টং ছিল ফরজীয় লেভেলের রুটিন। ‘ফুটপাত হকার উচ্ছেদ অভিযানের’ অংশ হিসেবে সেই বড় টং আর নেই। তার বদলে চাচার ‘চ্যাং টং’ এখন ছোট্ট একটি দোকান হয়ে ঠিক আমাদের ৯/বি বাসার গেটের পাশেই আশ্রয় নিয়েছে। মদিনা মার্কেটে নেমেই বাসায় ঢুকবার আগে চাচার খোঁজ নিলাম। ভালোই আছেন। সেদিন রাতেই ছোট আরেকটা আড্ডা বসে গেল। অপরিহার্য সূরা সদস্য সিনিয়র শামসীর & রসি ভাই সহ!




[৩]
সিলেটে আমি যে রুমে থাকতাম সেখানে এখন ফিজিক্সের রাজী থাকে। প্রতিবার ঢুকলেই একটা ধাক্কা মত খাই। শুধু সময়, মানুষ আর কিছু বাড়তি জিনিস বদলে গেছে। দেয়ালের সাথে দেয়াল-ঘড়িটা সেই একই আছে। এই ঘরের ফ্লোরের প্রতি ইঞ্চিতে নিজ পদ-চিহ্ন। বারান্দার গ্রিল দিয়ে এক ঝলক রাস্তা আর এই চোখের স্মৃতিও অভিন্ন।

বারান্দায় গেলেই অদ্ভুত কিছু স্মৃতি নাড়া দেয়। তৃতীয় বর্ষে থাকতে রাস্তার উলটো পাশের চটপটি দোকানে খেয়ে জন্ডিস বাঁধালাম। দেড় মাস ঢাকায় থেকে সুস্থ হয়ে যখন ফেরত আসছি তখনও শরীর কিছুটা দূর্বল। সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হতে ৫/৬ দিন বাকি। ইন্ড্রাষ্টিয়াল আর সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং-এর জন্যে চোখে অন্ধকার দেখছি (চশমা সহ)। এই সময় আমার সঙ্গী হিসেবে বারান্দায় আবির্ভূত হল একটি কবুতর। ২০ মিনিটের মধ্যে চাল দিয়ে এটাকে পোষ্‌ মানিয়ে ফেললাম। ঘরের জানালায় সে আশ্রয় নিল। কবুতরটা বৃদ্ধ, সাথে ঘুম-কাতুরে ছিল। হয় ঘুমাতো নাহয় ঢুলু ঢুলু চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকত। ইন্ড্রাষ্টিয়াল পড়তে পড়তে যখনই বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছাতাম, তখন আমিও দরজায় হেলান দিয়ে কবুতরের পাশে দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখতাম। দুপুরের কড়া রোদ কিংবা বিকালের শেষ আলো কিছুই আমাদের বিরক্ত করতো না। বারান্দায় গিয়ে দাড়ালেই ওটার কথা মনে হয়।

বড় বারান্দায় এইবারও ভাঙ্গা চেয়ারটাকেই পেলাম। এই চেয়ারের বয়স কমপক্ষে ৭ বছর। রূম-মেট সাফায়েত কিনেছিল। ওরা অস্ট্রেলিয়া চলে যাবার পরে চেয়ারটির জায়গা হয় বারান্দায়। ঝড় হোক বা বৃষ্টি-- এটাতে বসেই আমাদের মেসের নওজোয়ান সদস্যরা ডিজুসের ফ্রি মিনিটের সর্বোত্তম ব্যবহার করত। গ্রামীণ ফোণ কর্তৃপক্ষ যদি চেয়ারটির আত্ম-ত্যাগের কাহিনী শুনতেন তাহলে নিশ্চয়ই লোগোর অল্প একটু জায়গা জুড়ে এটি স্থান পেত।

সিলেটে এই প্রথম ট্যুর যেবার ২-কে ব্যাচের ‘নাতি’র সাথে দেখা হল না। বহুবার, বহুসময় ঈদগা সংলগ্ন সেই বাসায় গিয়েছি। কিন্তু, ওর বাবা মারা যাবার পরে এই প্রথম যাওয়া। বাসাটা পুরো খালি হয়ে আছে। একধরনের নিঃসঙ্গতা বোধ করলাম ওর বাসায় গিয়ে।



[৪]
৫ তারিখ খুব সকালেই গাউন আর আইডি কার্ডের জন্য ভার্সিটি গিয়ে আমরা হাজির। সোহাগ আর ফেকুকে এত সকালে ঘুম থেকে তোলা যাবে প্রথমে কেউ আশা করি নাই। অফিস জীবন সবাইকেই কিছু পরিবর্তন করেছে। ৮ টার মধ্যে সবাই ঘুম থেকে উঠে পড়ে!!

লাইনে দাড়ানো মাত্রই ফটো-সেশন শুরু হল। যথারীতি ধাক্কা-ধাক্কি করে লাইনে সবাই নিজের অবস্থান
পুনঃপুনঃপ্রতিষ্ঠিত করল। গাউন জোগাড় হবার পরে ক্লাসমেট তানভীর ‘স্যারের’ দর্শন নিতে রওনা দিলাম। দর্শন শেষে নিচে নেমে জাফর স্যারের সাথে ফটো-সেশন। সাথে টুকরো, টুকরো আড্ডা তো চলছেই।

পরদিন সমাবর্তন। দেড় ঘন্টা rally লাইনে দাঁড়িয়ে একজন rally sort algorithm আবিষ্কার করে ফেললো। এরপর দুই ঘন্টা চেয়ারে বসে ঝিমোবার পরে রাষ্ট্রপতি মহোদয় আসলেন। আমরা গ্রাজুয়েট ঘোষিত হলাম। এরপর শুধু ক্যামেরার শাটারের শব্দ মনে পড়ছে। শেষ বিকেলে সিনিয়রদের সাথে আড্ডাটা অনেকেরই মনে থাকবে। জহির স্যার কিংবা তৌফিক ভাইদের মত বুড়োদের সাথে লম্বা আড্ডা হল।

কনভোকেশন রাতে আমরা ফেয়ারওয়েল পার্টিতে জড়ো হলাম সিলেটের চৌহাট্টার আল-হামাদান রেষ্টুরেন্টে। বিদায় ঘন্টা ক্ষীণ স্বরে বাজতে শুরু করেছে। অনেকের অফিস শনিবার! ছাত্রত্ব অনুভূতি ত্যাগ করে আবার কর্মস্থলে ঢুকতে হবে। বৃহস্পতিবার রাতেই তারা সিলেট ছেড়ে রওনা দিলো।

পরদিন ইউনিভার্সিটিতে সার্টিফিকেট তুলবার পরে বিশ্বদার সাথে দেখা। ডি-বিল্ডিং এর সামনে ভাবীকে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। সামনে যাবার পরেই বললেন, ‘সুনামগঞ্জে যখনই আসি, ফেরত যাবার পথে রিক্সা করে ইউনিভার্সিটিতে একবার ঢুঁ মেরে যাই। গোল চত্বর থেকে এ-বিল্ডিং একবার রিক্সা দিয়ে ঘুরেই ভার্সিটি থেকে বের হয়ে পড়ি। রিক্সা থেকে নামি না। অথচ এইবার যেতে ইচ্ছা করছে না।’



[৫]
“Just like before
It’s yesterday once more”


সিলেট জীবনটাই ছিল অন্যরকম। যারা বাইরে থেকে সিলেটে প্রথমবার গিয়েছিলাম, তাদের কাছে অনেকটা হিজরত করার মত ব্যাপার। চেনা একটি শহর ছেড়ে অচেনা অন্য শহরে যাওয়া। সমাবর্তনের ২টি দিন শুধু সেই অচেনা শহরে ছয় বছর কাটানো সময়ের স্মৃতিময় ঝলকানি।

ভার্সিটির প্রথম (২০০১) এবং শেষদিন (২০০৬) এখনও অনায়াসে মনে পড়ে। বড় অডিটোরিয়ামে গিয়ে সবাই জড়ো হয়েছি। পার্থ স্যার এসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে লেকচার দেওয়া শুরু করেছে। একটু পরে জাফর স্যার এসে হাজির। বেড়াল মারার গল্প, সাথে ভারী ভারী কিছু কথা। বের হয়ে নতুন মেস সুরমায় চলে গেলাম। স্বাধীন জীবনের শুরু। মেসের ২/৩ জন মিলে চলে যাই আম্বরখানায় [মদিনা মার্কেট তখন শূন্য]। প্রয়োজনীয় হাড়ি-পাতিল কিনে আনি। রাতে বসে একনাগাড়ে এলোপাথাড়ী গল্প।

আর শেষদিন বড় অদ্ভুত। ইউনিভার্সিটি অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে বসে আছি থিসিস প্রেজেন্টেশনের জন্যে। তারিখ পিছিয়ে পরের মাসে গেলো। যে যার মতো ফিরে আসলাম নিজ পিতৃস্থলে। শুরু এবং শেষটা একইরকম হল। যে যার মতো বিচ্ছিন্নভাবে সিলেটে গিয়েছিলাম, বিচ্ছিন্নভাবেই শেষবারের মত চলে এসেছি।

এর ঠিক দেড় বছর পর সমাবর্তনে আবার সবাই একসাথে হয়েছি। ভার্সিটি অনেক সুন্দর সাজিয়েছে। যেখানেই ঢুঁ মারি সেখানেই স্মৃতিও ছায়ার মত সাথে সাথে ঢুঁ মারে। কে যেন প্রথমদিন জিজ্ঞাসা করল, “ওই বড় টয়লেট চাপসে! কোনটাতে যামু রে?” একটু চিন্তা করে কোনো সন্দেহ ছাড়াই ৩১০ নম্বর রূমের উত্তর পাশের টয়লেটে যাবার পরামর্শ দিলাম। সমাবর্তনের পরদিন ১ম বর্ষেই ইন্ডিয়া এক্সপোর্টেড সমিত আসলো সিলেটে। ফোনে ওকে রাস্তা-ঘাট চেনাতে হল!! এরপর মেডিকেলের উল্টোদিকে রেষ্টুরেন্টে আড্ডা দিলাম।

সাত তারিখ রাতে বড় একটা গ্রুপ ঢাকায় ফেরত আসছে। বাস স্টেশনে গিয়েছি ওদের সিলেট থেকে আবার বিদায় দেবার জন্যে। এরমধ্যে দেখি রাজী আর নায়েম ভাই গাড়ী নিয়ে হাজির। খাদেম ব্রীজে যাবে। রওনা দিলাম ১১.৩০ টার দিকে। ব্রীজে যখন পৌছলাম তখন রাত ১২.৩০। পাশেই সুরমা নদী। তিনজনই শীতের মধ্যে লম্বা হয়ে ব্রীজের ফুটপাতে শুয়ে পড়লাম। ‘তারকা-স্নান’ বলে বাংলায় কোনো শব্দ আছে কিনা জানি না। তবে, তারাগুলো হাত বাড়িয়ে ধরতে কোনোমতে বাকি রেখেছিলাম।

Carpenters এর পুরোনো, অসম্ভব সুন্দর একটা গান আছে, স্মৃতি-জাগানিয়া টাইপের। স্মৃতি-চারণের সব গল্পই সম্ভবত অসমাপ্ত ধরণের হয়ে থাকে। একে যতিচিহ্ন দিয়ে পূর্ণ সমাপ্তি দেওয়া যায় না। চলতে থাকা এই বিচ্ছিন্ন গল্পগুলোও নাহয় “ইয়াস্টারডে ওয়ান্স মোর” এর আরেকটি সাক্ষী হয়ে থাকুক।।

Those were such happy times
And not so long ago
How I wondered where they'd gone
But they're back again
Just like a long lost friend
all the songs I loved so well....

0 টি মন্তব্য: