Apr 21, 2008

জোটে যদি একটি পয়সা

পূর্বে প্রজন্ম ফোরামে প্রকাশিত


[পাস করবার পরে ৩ মাস মেয়াদী একটা বেকার জীবন কাটানোর সুযোগ হয়েছিলো। একেবারেই অন্যরকম একটা সময়। ছন্নছাড়া কিছু লিখতে ছন্নছাড়া সময়ের উদাহরণের চেয়ে ভালো কিছু হয় না। :p]
[১]
২০০৬ – জুন। আন-অফিসিয়ালী বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হল মাত্র। রেজাল্ট হয় নাই। আগামী ২০ দিনের করণীয় মনে মনে ঠিক করে ঢাকার বাসায় এসে ঢুকলাম। ৭ দিন বিশ্রাম, সাথে মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর ‘69’ নাটকের বাকি পর্বগুলো একটানা দেখে শেষ করব। বেশ কিছু জমে থাকা মুভী আছে। সিলেট থেকে আসবার আগে নাতির কাছ থেকে কমেডি সিরিজ “ফ্রেন্ডস” এর ৫টা ডিভিডি হার্ড-ডিস্কে কপি করে এনেছি। সেগুলোও দেখে শেষ করতে হবে। এর ফাঁকে কিছু সময় বের করে সিভি প্রস্তুত করব। বেশ কিছু আড্ডা পেন্ডিং আছে স্কুল বন্ধুদের সাথে। এরপরও কিছু সময় বেচে গেলে বিডিজবসে ঢুঁ মারা যাবে।

প্রথম তিনদিন-চারদিন রিপ ভ্যান উইঙ্ক্যালের মত ঘুম দিলাম। এরপর হৃষ্ট চিত্তে প্যাকেট খুলে কম্পিউটার জোড়া লাগাতে বসেছি। ফ্লোরে পড়ে আছে বড় বড় ৩ কার্টুন ভর্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের 4 বছর কারিকুলামের সব বই। প্যাকেট করা দেখলে এক ধরনের শান্তি শান্তি লাগে। তাই, ওভাবেই পড়ে থাকলো পরের ২ মাস।

কম্পিউটার লাগানোর পরপরই কুনো ব্যাঙের মত আলসে হয়ে গেলাম। সারাদিন শুয়ে শুয়ে ‘69’ দেখি। আরিফ, দিদার, মুকুল সবাই সিলেটেই এই নাটকের সেঞ্চুরী পূর্ণ করেছে। আমি ১৫-২০ পর্ব একসাথে দেখেছি। কিন্তু, পরীক্ষার মৌসুমের ২০-২৫ দিন বাকি থাকলেই রাত ১০টায় চোখ অন্ধকার হয়ে আসে। তাই, লেট নাইট শো হিসেবে ওদের সাথে দেখা হয় নাই। চমৎকার অভিনয় সবার। হাসান ভাইয়ের গান, আহমেদ রুবেলের শুচিবায়ু, তিশার ন্যাকামী এবং তিন্নির প্রেম দেখতে দেখতে সময় উড়ে যেতে লাগলো। খুব শীঘ্রই ১০০ পর্ব শেষ হয়ে গেলো। তিশার মৃত্যুতে ব্যথীত হবার চেয়ে, এরপরে কি করবো তার চিন্তায় তখন জাবর কাটছি।

ততদিনে দেড় সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। মেইল চেইক করতে বসলে মরূর মধ্যে চিকচিকে পানির মত মাঝে-মধ্যে যখন ২-১টা মেইল আসেঃ “I joined...”, আমরা হুমড়ি খেয়ে মেইল পড়ে সেই বন্ধুকে অভিনন্দন জানাই। এরপর খানিকক্ষণ নিজেকে নিয়ে চিন্তার উদ্রেক হয়। অতঃপর আবার অন্য মেইলগুলোয় ডুবে যাই।

রাতের বেলা নিবিষ্ট মনে পেঁচার জীবনকে অনুসরণ করি। বিশ্বকাপ ফুটবল’০৬ চলছে। নিজ ঘরে টিভি ২৪/৭ অবস্থান নিয়েছে। আর্জেন্টিনা ১ম রাউন্ডে তুমুল খেলছে। প্রতিবার আর্জেন্টিনা যতক্ষণ টুর্ণামেন্টে টিকে থাকে, আমি ব্রাজিলের ঘোর-বিরোধি। বাদ পড়লেই ব্রাজিল সমর্থক হয়ে যাই। মেসিকে নিয়ে বিরাট হৈ-চৈ। আর্জেন্টিনার খেলা হলেই দেখা যায় ম্যারাডোনা গ্যালারীতে বসে “মেসি, মেসি” স্লোগাণ দেয়। এই মেসিকে ভালো না লেগে যাবে কোথায়?


[২]
উষ্ণ দিনগুলো দ্রুত কেটে যেতে থাকে। থিসিস প্রেজেন্টেশনের তারিখ হয়ে গেলো। অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ ইউনিভার্সিটিতে সবাই উপস্থিত হয়ে প্রেজেন্টেশন দিয়েও এলাম। বিডি-জবস.কম পরিনত হল ব্রাউজারের হোম-পেজে।

বেকার বেকার ভাবটা ততদিনে প্রবলভাবে জেঁকে বসেছে। সিভি ড্রপ করা ছাড়া তেমন কোনো কাজ নাই। কিছু ইন্টারভিউ দিলাম। কিন্তু, ব্যাট-বল মিলিয়ে জয়েনিং হচ্ছে না। রোজ সকালে ১০টায় ঘুম থেকে উঠি। এরপর রাজসিক ভাব নিয়ে নাস্তা করি। এরপর টুক-টাক কাজ, নাহলে ব্রাউজিং। বাসায় ইন্টারনেট সংযোগ নেওয়া হয়েছে। দারুন সব সুবিধা। আইএসপির সার্ভার থেকে সরাসরি মুভী চালানো যায় রিয়েল প্লেয়ারে। হাজারখানেক মুভীর বিশাল এক লাইব্রেরী। মুভী ভালো না লাগলে কিছুক্ষণ হাই তুলে ঘুমের প্ল্যান করি। এহেন বয়ে যাওয়া দিনে তেমন কোনো অভাব অনুভূত হয় না। আম্মা এসে মানিব্যাগে একসাথে বেশ কিছু টাকা রেখে যায়। সাবলম্বী ছাত্র জীবন থেকে হঠাৎ করেই বেকার জীবনে প্রবেশ হেতু সেই টাকা শেষ হয়ে গেলেও বলতে ইচ্ছা করে না।

এক শুক্রবার সকালে মৌচাক গন্তব্য করে বের হচ্ছি। মানিব্যাগ খুলে দেখি একটা মাত্র ২০ টাকার নোট সগৌরবে উঁকি দিচ্ছে। যথেষ্ট মনে করে পকেটে মানিব্যাগ চালান দিলাম। রিক্সা ভাড়া দিয়ে মৌচাকে নেমেছি। কাজ প্রায় শেষ এমন সময় রূপম ভাইয়ের ফোনঃ

- ‘ওই রুমন! আজকের ডেইলী স্টার দেখসো?’
- ‘নোপ বস। বাসায় প্রথম আলো রাখি।‘
- ‘হুম! ডেইলী স্টার কিনে ফেলো। অমুখ কোম্পানীর বিরাট সার্কুলার দিসে।‘
- ‘ওকি-ডোকি! ঠ্যাং-স’।
- ‘নো প্রব! একদিন সময় দাও। তোমারে নিয়ে খাইতে বের হবো।‘ [রূপম ভাই সবসময় খাবারের শিডিউল করে। ]
- ‘আমি তো অলয়েজ ফ্রি।‘

একটা ডেইলী স্টার কিনে ফেললাম। রয়ে যাওয়া ২ টাকার নোট আবার পকেটে চালান দিয়েছি। সার্কুলার দেখতে দেখতে সেগুনবাগিচার দিকে হাঁটা দিবো নাকি ক্যালকুলেশন করছি, মোড়ে বাস পেয়ে গেলাম। পল্টন নেমে পকেটের শেষ কাগুজ নোটটাও দিয়ে দিলাম। সেগুনবাগিচার দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনে উচ্চ মার্গিক চিন্তা চলছে। কি মনে হল, খালি মানিব্যাগ বের করে আনলাম। ইউরেকা! মানিব্যাগের ছোট পকেটে ১ টাকা মূল্যের ১টি কয়েন!

হুবুহু এই সময়টা আর কখনো আসবে না; তাই, পরের ২ দিন ওইভাবেই রয়ে গেলাম। ঘরকুনো হয়ে থাকি, বাইরে বের হতে হলে শুধু ওই কয়েনটা নিয়েই বের হই। ঘুমিয়ে আছি, আম্মা এরমধ্যেই এক সকালে এসে এই অবস্থা দূর করে দিলেন।
*************

কাছের অনেক বন্ধুকেই অনুভূতিটা বলেছি, কেউ বুঝেছে, কেউ বোঝেনি। ১ মাস পর এখনকার অফিসে আমার জয়েনিং ডেট। এইচআর ডিপার্টমেন্টে বসে আছি, এক বন্ধু এসএমএস পাঠালো, “চিন্তা করে দেখ্‌! ওই এক টাকার সুখ আর কখখনো পাবি না! জয়েন করবি?? ঃ))”
*************
[সংক্ষেপিত।]

ছবিঃ  সিসিএল- এর নীতিমালার আওতায় ব্যবহৃত।

1 টি মন্তব্য:

Zakaria Chowdhury বলেছেন...

বন্ধু দারুন লিখেছিস। তোর বেকার জীবনের কাহিনী পড়ে সত্যি লোভ হচ্ছে। আমিতো জানিসই ছাত্রজীবনে থাকতেই চাকুরীতে যোগ দেই, তারপর পাশ করার পরপরই ইন্টারনেটে ফ্রিল্যান্সিং, এখন আবার নিজের সফ্টওয়্যার ফার্ম। মাঝেমধ্যে মনে হয় কয়েক সপ্তাহের একটা ব্রেক হলে মন্দ হতো না - কয়েকদিন লম্বা ঘুম, বন্ধুদের সাথে অকারণ আড্ডা, সারাদিন মুভি দেখা, তারপর আবার ঘুম... বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের লম্বা লম্বা ছুটিগুলোকে খুবই মিস করি।

তবে কামনা করি বেকার জীবন যেন কারো কখনো দীর্ঘস্থায়ী না হয়। ওই সময়টাতে সুখের সাথে যন্ত্রণাও কিন্তু কম নয়।