May 19, 2008

মাঝ আকাশের ধূমকেতু

ধূমকেতুরা হঠাৎ করে আসে, আর হঠাৎই চলে যায়। থেকে যায় শুধু ভাললাগা। তৃতীয় দিনের মত পরিচয়। নামটা এখনও জানি না। কিন্তু ক্ষণিকের ধূমকেতুও যে আমাকে আলোড়িত করতে পারে তা দেখে কিছুটা আশ্চর্যই হচ্ছি। বহুকাল পরে টিনএইজ সময়কার সেই উত্তেজনা আজ আনুভব করছি। সে একটা সময় ছিল, হা হা হা..., যাকে দেখতাম তাকেই ভাল লাগত আর সারাক্ষণ গাইতাম "মন কি যে চায় বল, যারে দেখি লাগে ভাল। এ মন কেন বাধা পড়েনা, কি যেন কেন জানি না।"

প্রথম দিনঃ
লাব্রেরীতে বসে পড়ছিলাম। আমার টেবিলে পাশের দুটি চেয়ারে দুটি মেয়ে অনেক্ষণ থেকে বকবক করছিল। তাকিয়ে দেখিনি, কিন্তু বুঝতে পারলাম বয়েস কম ২০-২২ হবে। বয়সে এখনও পরিপূর্ণতা আসেনি, পাশের লোকজনের যে পড়ায় বিঘ্ন ঘটছে সেদিকে কোন খেয়াল নেই। অতঃপর কি আর করা বইয়ের দিকে অকারণে তাকিয়ে থালাম আর ভাবছিলাম এরা কখন থামবে!

কিছুক্ষণ পর তৃতীয় চেয়ারে আরেকটা মেয়ে এসে যোগ দিল - ষোলকলা পূর্ণ হল আরকি। আড়চোখে তাকিয়ে বুঝলাম মেয়েটা বাকি দুজন থেকে বড়। মনে মনে ভরসা হল সে হয়ত বাকি দুজনকে একটু চুপ থাকতে বলবে। কিন্তু সেটা কি কখন সম্ভব - তিন মহিলায় যে হাট-বাজার সেটা আরেকবার প্রমাণ হল। শুনলাম সে মাস্টার্সে পড়ে এবং বাকি দুজনের সাথে আজি তার প্রথম পরিচয়। কিন্তু তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছিল অনেকদিনের পরিচয়।

একসময় লিসেনিং টেস্ট দেবার জন্য আমার পালা এল, হাঁফ ছেড়ে বাচলাম। কিন্তু পড়লাম আরেকটা বিপদে, সেদিনই প্রথম ব্রিটিস কাউন্সিলের সেলফ এক্সেস সেন্টার (স্যাক) বা লাইব্রেরীতে এসেছি। বুঝতে পারছিনা কোন বই থেকে লিসেনিং টেস্ট দিব। অতগ্যা উপায় না দেখে প্রথম মেয়ে দুটিকে জিজ্ঞেস করলাম। তাদের মধ্যে একজন আমাকে একটা বই সেলফ থেকে এনে দিল।

টেস্ট দিলাম, একঘন্টা সময় লাগল। ৪০ মার্কসের মধ্যে ৩৭ পেলাম। প্রথম টেস্টে এতটা আশা করি নি। সে যাইহোক, খুশি মনে আগের চেয়ারটাতে এসে বসলাম। মেয়েরা তখনও বকবক করছিল। আমি কিছু বলছিলাম না, নিজ মনে আরেকটা বই পড়ছিলাম। মিনিটখানেক পর প্রথম মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, "কত মার্কস পেয়েছ?"। অপরিচিত কাউকে যে আপনি করে বলতে হয় সে জ্ঞানটুকু নেই, অপরিনত বয়স বলে ক্ষমা করে দিলাম। বললাম, "৩৭"। "৩৭ ?!? দেখি তোমার খাতা"। তার এতটা উচ্ছ্বাস দেখে মনে মনে হাসলাম আর খাতাটা তার দিকে দিলাম।

তৃতীয় মেয়েটা এই প্রথম আমার সাথে কথা বলল,
"কিভাবে এত মার্কস পেলেন?"
আমি এই প্রথম তার দিকে তাকালাম, আপনি করে বলায় তার পরিপূর্ণতা নিয়ে আর কোন সন্দেহ থাকল না, "জানি না, প্রথমবারে ৩৭ পেয়েছি, আর পাব বলে মনে হয়না। "
"কি বলেন? প্রথমবারেই ৩৭? কিভাবে সম্ভব? "
"তাতে কি হয়েছে, পরেরগুলোতে এরকম নাও পেতে পারি। "
"আপনি পাবেন। আপনি এখন কিসে পড়েন?"
"আমি ২ বছর হল শাবিপ্রবি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে গ্রেজুয়েশন করেছি। "
"তাহলে তো আপনি খুবই ভাল ছাত্র। IELTS এর কোর্স করেছেন কোথা থেকে?"
"ITSE থেকে, তাও আবার দুবছর আগে। "
"সবই দেখি দুইবছর আগে করেছেন!"
"হ্যাঁ, পাশ করার পর পরই কোর্সটা করেছিলাম কিন্তু জব এর কারণে আর ফাইনাল টেস্ট দেয়া হয়নি।"
"এখন কোথায় জব করছেন?"
"আমার একটা সফ্টওয়্যার ফার্ম আছে।"
"স্যরি", আমার কথা বুঝতে পারেনি, ২৬-২৭ বয়সের একজন লোকের যে নিজস্ব একটা সফ্টওয়্যার ফার্ম থাকতে পারে তা বেশির ভাগ লোকেই প্রথমবার বললে বিশ্বাস করতে চায় না। ভাবে আমি ঠিক করে বলতে পারিনি, না হয় তারা ঠিক করে শুনতে পারেনি। সে যাই হোক আমি তাকে আবার বললাম। সে বলল "ও"। আমি নিশ্চিত সে এবারও বুঝতে পারেনি।

প্রথম মেয়েটা এইবার আমার দিকে অপরাধ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে বলল, "ভাই আমি দুঃক্ষিত, আমি আপনাকে তুমি করে বলে ফেলেছি। আমি বুঝতে পারিনি আপনি অনেক সিনিয়র। আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাদের সমবয়সী।" আমি বলাম, "ঠিক আছে কিছু হবে না। আপনারা দুজন কোথায় পড়ছেন?" "আমি মহিলা কলেজে এবং আমার বান্ধবী ল কলেজে, দুজনই প্রথম বর্ষে।" কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর প্রথম দুজন চলে গেল। যাক এইবার একটু পড়া যাবে। কিন্তু না, সেটা মনে হয় আজ আর হবেনা। তৃতীয় মেয়েটার চোখেমুখে ঘোর তখনও কাটেনি, একটার পর একটা কথা বলে যাচ্ছে। যেহেতু কথাগুলো আমাকে নিয়েই হচ্ছে তাই ভালই লাগছিল শুনতে।

দ্বিতীয় দিনঃ
লাইব্রেরীতে এসে দেখলাম এখনও তেমন কেউ আসেনি। নিরিবিলি একটা জায়গা দেখে চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। মনযোগে বিঘ্ন ঘটল পাশের চেয়ার টানার শব্দে। বলল, "Hi" - মুখে প্রশস্থ হাসির রেখা। "কেমন আছেন?" "ভালই, আপনি?" "এইতো"। মনে হচ্ছে আজ আর কোন পড়া হবে না। আমাকে নিয়ে তার ঘোর এখনও কাটেনি, "আপনি খুবই ভাল ছাত্র।"
"না না, এতটা ভাল নই", তাকে শান্ত করার জন্য বললাম।
"তাহলে কম্পিউটার সায়েন্সে চান্স পেলেন কিভাবে?"
"চান্স পেয়েছি, কিস্তু আপনি যতটা ভাল ছাত্র মনে করছেন ততটা আসলে নই।"
"তাহলে লিসেনিং টেস্ট এ ৩৭ পেলেন কিভাবে?", বুঝতে পারলাম কথাটা সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। লক্ষণ ভাল ঠেকছে না। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললাম, "এটা কোন ব্যাপার না। ওই টেস্টটা সহজ ছিল। আর আমি প্রায়ই ইন্টারনেটে বিবিসির খবর শুনি। এটা গত এক বছরে চেষ্টার কারণে হয়েছে। "
"ও তাইতো বলি, তাহলে তো আপনি পারবেনই।" শুনে আশ্বস্ত হলাম। "তবে আপনি কিন্তু সত্যি ভাল ছাত্র, আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়।" কম্প্লিমেন্ট শুনে আমি আর কিছু বলাম না, হাসলাম।

ওইদিন লিসেনিং টেস্টএ ৩৩ পেলাম। খারাপ করায় মনে মনে খুশি হলাম, আমাকে অন্তত মহামানবের পর্যায়ে আর ফেলতে পারবে না। মার্কস শুনে সে বলল, "অনেক ভাল করেছেন, আমি তো কখনও ২৯ এর উপর যেতে পারি নি। প্রথমটাতে আবার পেয়েছিলাম ২৩। আমাকে দিয়ে হবে না। আচ্ছা আপনি কি জব থেকে ছুটি নিয়েছেন?"

আমার ধারণাই সত্যি হল, বললাম "আমার ছুটি নেবার কোন দরকার নেই, সফ্টওয়্যার ফার্মটা আমার নিজেরই।" এতক্ষণে সে আমার কথা বুঝতে পারল, চোখে কিছুটা বিশ্বয়, "ও তাহলেতো খুব টাকা ইনকাম করছেন।" "হা হা হা, ভালই বলেছেন"। তারপর অনেক কথা হল। একসময় বললাম, "আজ আর পড়া হবে না, আমি যাচ্ছি।"

চলে আসার পর মনে হল নামটা এখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি। পরের দিন প্রথমে গিয়েই জিজ্ঞেস করব। মধ্যে শুক্র-শনিবার বন্ধ। এই দুইটা দিন ঘোরের মধ্যে কাটল, সারাক্ষণ কানের কাছে তার হাসির শব্দ বাজতে থাকল। টিনএইজের সেইসব দিনগুলি বারবার মনে পড়তে থাকল।

তৃতীয় দিনঃ
আজকে লাব্রেরীতে আসতে আর দেরি করলাম না। দেখলাম সে আমার আগেই এসে বসে আছে। দূর থেকে সেই প্রশস্ত হাসি দিল। আমিও যতটুকু সম্ভব বড় একটা হাসি দিয়ে স্বাগত জানালাম। লাইব্রেরীর কম্পিউটারগুলো খালি পড়ে থাকায় সময় থাকতে একটাতে বসে পড়লাম লিসেনিং টেস্ট দেবার জন্য। সেও দেখলাম আরেকটাতে বসে পড়েছে। আজ পেলাম ৩০। এতটা খারাপ হবে আশা করি নি। মনে মনে নিজের উপর বিরক্ত হলাম। ঠিক করলাম এখানে যে কাজে জন্য এসেছি তা না করে ধূমকেতু ধরতে গেলে আমার কপালে দুঃখ আছে। আমি তখন একটা চেয়ারে বসে পড়া শুরু করলাম। পাশের চেয়ারটা খালি ছিল। মনে মনে আশা করেছিলাম, কিন্তু দেখলাম সে আমার টেবিলে না এসে পাশের টেবিল একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। পুরনো কোন এক বন্ধুর সাথে কথাবার্তা বলছে।

কিছুটা অভিমান হয়েছিল, কিন্তু পরক্ষণে মনে পড়ল আজ ওই বন্ধুটার আর কোন পড়া হবে না। সময় থাকতে সাবধান হতে হবে, তা না হলে উচ্চতর শিক্ষার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। অতএব সেদিনের মত ধূমকেতু দর্শনের এখানেই পরিসমাপ্তি টানলাম আর মনে মনে Winnings এর সুরে সুরে বললাম, "ধূমকেতু হয়ে গেলে মোরে ছুয়ে, রয়ে গেলে হৃদয়ে জ্যোতিষ্ক হয়ে।"


বিঃদ্রঃ চতুর্থ দিন কিন্তু এখনও আসেনি, তাই জানিনা পরের গল্পটার শিরোনাম কি হবে।

13 টি মন্তব্য:

Anonymous বলেছেন...

That is nice, Zak....I didn't know that you go to British Council not only for IELTS but also for some Other purposes.......

Shams বলেছেন...

জ্যাক খুব ভাল লিখেছিস। পড়ে ভাল লাগল।

চালিয়ে যা। ধরা মনেহয় খেয়ে গেছিস মনের কাছে।

Shehab বলেছেন...

হতভাগা।

সজীব বলেছেন...

Zak, you still have chance to do something.
Anyway, the writing was nice!

Alimul Razi বলেছেন...

buro boyose bhimroti

Anonymous বলেছেন...

iha fact na fiction?

mamu ekkhan khowa pawna hoise tomar...

Unknown বলেছেন...

চালাই যাও ZAK.....
4th day ty obhiman kore theko na..
miss hoye jabe...

Unknown বলেছেন...

Nice Jack.I am also waiting for the 4th Day and for the happy ending.

শান্ত ছেলে বলেছেন...

মন্তব্যের জন্য সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। মন্তব্যগুলো পড়ে আমি সত্যি অভিভূত।

এবারে গল্পটা সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলতে চাই। এটাকে সত্যি ঘটনা বলার চাইতে একটা ছোটগল্প বলাতে আমি বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করব। গল্পে উল্লেখিত অনেককিছুই কিন্তু বাস্তব নয় এবং কিছু সত্য আমি গোপন করেছি। বাস্তবে গল্পটা কিন্তু এতটা ইন্টারেস্টিং এবং মনে রাখার মত ছিল না।

এটা আমার লেখা প্রথম ছোটগল্প। সম্পূর্ণ কল্পণানির্ভর গল্প কিভাবে লিখতে হয় আমার জানা নেই। তাই গল্পের কাহিনী হিসেবে আমি আমার চারপাশের পরিবেশ নির্বাচন করেছি। তারপর খুবই সামান্য একটা বিষয়কে ইন্টারেস্টিং এবং নাটকীয় করার চেষ্টা করেছি মাত্র। সবার ভাল লাগলে সেটাই হবে আমার সার্থকতা।

বন্ধুরা তোমরা জানতে চেয়েছ চতুর্থদিন কি হবে। যেহেতু আমি এটা নিয়ে আর কোন গল্প লিখছি না তাই আমিও জানি না এরপর কি হবে। এটা উল্লেখ করেছি এমন একটা উপলব্ধি দেয়ার জন্য যাতে মনে হয়, শেষ হইয়াও হইলনা শেষ। আর বাস্তবে কি হয়েছিল সেটা না হয় নাইবা বললাম :)

Anonymous বলেছেন...

সংবিদিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ ধূমকেতু হইতে সাবধান। নাহলে ইহা মাথার উপরে ডাউনলোড হইয়া জ্যোতিষ্ক রূপে অবস্থান করিবে।

রেফারেন্সঃ উইনিং-এর গানঃ ধূমকেতু।

শামীম বলেছেন...

বেশ ভাল ;) ।

Unknown বলেছেন...

very nice story.

মর্মর বলেছেন...

জাকারিয়া ভাইয়ের ব্লগ হয়ে আপনাদের এ সাইটায় প্রথম এলাম ।
শান্ত ছেলে, জব্বর লিখছেন..........১০০/১০০..............................ইঞ্জিনিয়ার না হলে,লেখক হইতে পারতেন........................ফাটাফাটি.............(ফাটলেন না কি!!)